কিংকর্তব্যবিমূঢ় রাজীব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অর্ডার অর্ডার অর্ডার ......’’সমস্ত সাক্ষী প্রমানের ভিত্তিতে আদালত এই মর্মে রায় ঘোষণা করছে যে আলাউদ্দিন ওরফে সুন্দরী কে শারীরিক ভাবে অত্যাচারের অপরাধে আসামী সফিউল কে ১০ দিনের বিনাশ্রম কারাদন্ড এবং সাথে ৫০০০ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আর ৩ দিনের জেল দেয়া গেল ।‘’
আলাউদ্দিন । একুশে হলের ক্যান্টিনের একজন কর্মী । তার কাজ হল সকল টেবিল গুলো পরিষ্কার করা আর কাস্টমারদের পানি দেয়া । হলে আমি তাকে প্রথম দেখি ১৯৯৫ সালের জুন মাসে । দেখি একটা ছেলে কে সবাই সুন্দরী বলে ডাকছে । হ্যা আলাউদ্দিন আসলেই সুন্দরী । অনেক স্মার্ট । সারাদিন তার মুখে গান থাকে । ক্যান্টিনের ম্যানেজার তাকে মাঝে মাঝে খুব বকাঝকা করে । কিন্তু তাকে দেখতাম হাসি মুখে সব মেনে নিত । জানুয়ারির এক সকালে ক্যান্টিনে বসে পরোটা খাচ্ছি ।
সুন্দরী এসে আমাকে বলল –মামা ঘর পরিষ্কার করাবেন নাকি ?
হ দরকার তো । তুই পারবি ।
হ পারমু না ক্যান ?
কত করে নিবি ?
মামা সবাই যা দেই তাই দিয়েন । মাসে ২০০ ট্যাহা ।
ও আচ্ছা । ঠিক আছে । তা কখন আসবি ।
মামা দুপুরে রুমে থাহেন না । ৩ টার পর আসি ।
আচ্ছা ঠিক আছে । তাইলে কাল থেকে আয় ।
হ মামা ঠিক আছে ।
সুন্দরী তারপর থেকে কাজ করা শুরু করল ।
মাঝে মাঝে সুন্দরীর সাথে গল্প হত । সে ময়মনসিংহ থেকে এসেছে । তার বাবা রিকশা চালায় । অভাবের সংসার । তাই এত ছোট বয়সে কাজে চলে এসেছে । মাঝে মাঝে দেখতাম সুন্দরীর খুব মন খারাপ । জিজ্ঞাসা করলে বলত – না মামা কিছু না ।
কান্টিনের ম্যানেজার লোকটা ভালো ছিল না । সুন্দরী কে সে দেখতেই পারত না । সারাক্ষণ অকথ্য ভাষায় গালাগালি করত । আমি যখন ক্যান্টিনে খাইতে যেতাম তখন দেখতাম সুন্দরী ও মাঝে মাঝে ম্যানেজারের সাথে ঝগড়া করত ।
সে দিন ছিল শুক্র বার । বিকাল ৪ টা র দিকে আমি টিউশনির উদ্দেশ্যে রুম থেকে নিচে নামছি । দেখি সুন্দরীকে সবাই দরাদরি করে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে । ওর মাথা দিয়ে রক্ত পরছে । বুঝলাম ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাচ্ছে । ওদের কে জিজ্ঞাসা করলাম –কি হইছে ভাই । ওর এই অবস্থা ক্যান ? কেউ কোন উত্তর দিল না ।
পরদিন আমি ক্লাস থেকে রুমে ফিরছিলাম । দেখি পিছন থেকে কে যেন আমাকে ডাক দিল । আমি পিছনে তাকিয়ে দেখি আলাউদ্দিন ।
মামা আমারে একটু হেল্প করেন ।
আমি বললাম কি হেল্প?
মামা- আমি ম্যানেজারের বিরুদ্ধে কেস করব । আমার সাথে একটু থানায় চলেন ।
ও আচ্ছা । তাহলে ম্যানেজারের সাথে তোর গাঞ্জাম হইছে । আচ্ছা চল ।
আমি আর সুন্দরী থানায় গিয়ে কেস ফাইল করলাম । আমি যা যা ক্যান্টিনে দেখতাম তার বর্ননা দিলাম ।
বিকালে যখন নিচে আসলাম দেখি ম্যানেজার কে পুলিশে ধরে নিয়ে যাচ্ছে । আমি মনে মনে খুশি হলাম । ওই সময় সুন্দরী দৌড়াইতে দৌড়াইতে এসে আমাকে বলল – মামা কাল ই কোর্টে যাওন লাগব ।
আমি বললাম -আচ্ছা ঠিক আছে । তুই কোন টেনশন নিস না । সাবধানে থাকিস ।
কোর্ট চলছে । ম্যানেজারের উকিল সকল কর্মচারীদের জেরা করছে । কিছুক্ষণ পর আমাকে জেরা করার জন্য কাঠগড়ায় উঠানো হলো ।আমি যা জানতাম তার সব খুলে বললাম ।
আমাকে দেখেই উকিল বাবু বলতে লাগলেন – your honor, কাঠগড়ায় যে ব্যক্তিটা দাঁড়িয়ে আছে সেই হল আসল কালপ্রিট । আমি আমার এই উকিল জীবনে অনেক ধান্দাবাজ দেখছি । কিন্তু এই রকম ধান্দাবাজ দেখি নাই । সে ছাত্র নামের কলঙ্ক । your honor, এই সফিকুল নামের জানোয়ার টাই সুন্দরী কে অত্যাচার করেছে । সুন্দরী কে দিয়ে ম্যানেজারের বিরুদ্ধে কেস করাইছে । আসলে your honor, সে ম্যানেজারের কাছে চাদা চেয়েছিল । ম্যানেজার রাজী না হওয়ায় তাকে এমন বুদ্ধি করে ফাসাইছে ।
আমি ত হতভম্ব হয়ে গেলাম । বলে কি । আমি বললাম - your honor, আমি এসন কি শুনছি । আপনি সুন্দরী কে ডাকুন । তাহলে চোর মিথ্যাবাদী উকিলরের মুখোশ খুলে পরবে ।
উকিল বলল –হ্যা your honor, ডাকুন । তাহলেই আসল রহস্য বের হয়ে আসবে ।
তখন সুন্দরী ডাকা হল । সুন্দরী কাঠগরায় দাঁড়িয়ে বলতে লাগল – হুজুর আমি গরিব । তাই ক্যান্টিনে কাম কইরে খাই । আর যে টাইম পাই হেই টাইমে মামাগ রুম পরিষ্কার করি । আমি অই মামার রুমও পরিষ্কার করতাম । ঘটনার দিন আমি ওনার রুমে যাই । বলি মামা আমি ত দ্যাশে যামু । আমার বেতনদা যদি দ্যান ।
এই শুনে মামা চরম রাইগা গেল । আমারে বকতে লাগল। বলল –অই ২ দিন কাজ না করতেই টাকা । টাকা কি গাছে ধরে মাদারচোদ । টাকা টাকা করলে একবারে খুন করে ফেলব । তারপর আমার মা – বাপ তুইলা অনেক বকছে । আমি ও তহন রাগ কইরা তারে বকা দিছি । এরপর সে আমারে সটাম্প দিয়ে মাথায় বাড়ি দেয়
এতে আমার মাথা ফেটে যায় । এরপর আমার ক্যান্টিনের বন্ধুরা আমারে হাসপাতালে নিয়ে যায় ।
পরদিন ওই সফি মামা হাসপাতালে গিয়ে আমারে কয় – আলাউদ্দিন চল তোরে নিয়ে একটা কেস করি তুই কবি ম্যানেজার তোরে মারছে । তাইলে অনেক টাকা জরিমানা পাবি । আমি ও টাহার লোভে পইড়া গেলাম । তাই রাজি হয়ে গেলাম । কিন্তু যে আমারে ভাত দেই তার ক্ষতি আমি কেম্নে করি হুজুর বলেন । তাই আমি পারলাম না ।তাই আইজ আমি সব সত্য কথা কইয়া দিলাম । এই ধান্দাবাজের শাস্তি চাই আমি হুজুর । বলেই সে কাদতে লাগল ।
আমি বললাম - your honor, এর বিন্দু বিসর্গ ও সত্য না । এটা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ।
উকিল – ধর্মের কল বাতাসে নড়ে সফি সাহেব । পাপ বাপরে ছাড়ে না ।
তখন জজ সাহেব আমার দিকে তাকিয়া বললেন – সফি সাহেব , আপনার কি কিছু বলার আছে । ভিক্টিম নিজ মুখে সব স্বীকার করেছে । আপনি একজন চরম অভিনেতা । ভাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেরে কোন নাট্য দলে যোগ দেন ।
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না ।
জেল থেকে ছাড়া পেয়ে জানতে পারলাম আলাউদ্দিন আর হলে থাকে না । অনেক খুজেছি ওকে । কিন্তু পাই নাই ।
৩ বছর পর । গুলিস্তান ফোয়ারার পাশ দিয়ে যাচ্ছি । কে যেন পিছন থেকে ডাক দিল । আমি তাকিয়ে দেখি – আলাউদ্দিন।
কি রে তুই । এতদিন পর । মামা একটু গলির ভিতরে আহেন । কথা আছে ।
আমি বললাম- আচ্ছা চল ।
সুন্দরী বলতে লাগল – মামা ওই দিন মাত্র ২০হাজার টাহার জণ্য আপনার সাথে বেঈমানী করছিলাম । মামা ক্ষমা করে দিয়েন ।
আমি বললাম আচ্ছা যা ক্ষমা করে দিলাম ।
তা মামা এখন আপনার কাছে যা কিছু আছে তাই বাইর করেন । আজ একটা ক্ষ্যাপ ও পাই নাই । আপনি আজকের পইয়লা ।
আমি বলাম মানে কি ????
ও তখন প্যান্টের পকেট থেকে পিস্তল টা বের করে আমাকে দেখাল । আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। আমার চোখ গুলা ছানাবড়া হয়ে গেল । ম্যানিব্যাগটা বের করে দিলাম ।
আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম সুন্দরী আমার ম্যানিব্যাগ থেকে টাকা গুলো নিয়ে ম্যানিবাগ টা ছুড়ে ফেলে দিল । আর আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ।
এই গল্প টা আমার এক টিচা রের লিখা
ReplyDelete